হামিদা রহমান
হামিদা রহমান | |
---|---|
ভাষা সৈনিক অধ্যাপিকা হামিদা রহমান | |
জন্ম | (1927年07月29日) জুলাই ২৯, ১৯২৭ (বয়স ৯৭) |
মৃত্যু | ১৪ আগস্ট ২০০৫ |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
মাতৃশিক্ষায়তন | মধুসূদন তারাপ্রসন্ন বালিকা বিদ্যালয়, যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ |
পেশা | সাহিত্যিক ও সাংবাদিক |
পরিচিতির কারণ | ভাষা সৈনিক |
রাজনৈতিক দল | রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোরের যুগ্ম আহবায়ক |
দাম্পত্য সঙ্গী | সিদ্দিকুর রহমান |
পিতা-মাতা |
|
পুরস্কার | বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য |
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হামিদা রহমান (১৯২৭ সালের ২৯ জুলাই) যশোরের পুরাতন কসবায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যশোর একমাত্র নারী ভাষা সৈনিক ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের একাধিক পত্রিকায় ভাষা আন্দোলন ও নারী অধিকা নিয়ে তার লেখা প্রকাশ হয়।
ব্যক্তিগত জীবন
[সম্পাদনা ]হামিদা রহমানের বাবা শেখ বজলুর রহমান এবং মায়ের নাম বেগম লুৎফুন্নেছা। ১৯৪২ সালে নোয়াখালী নিবাসী সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে হামিদা রহমানের দুই ভাই শহীদ হন। [১]
শিক্ষা জীবন
[সম্পাদনা ]হামিদা রহমান ১৯৪২ সালে যশোর মধুসূদন তারাপ্রসন্ন বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৭ সালে সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে আইএ, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ১৯৫৮ সালে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৫ সালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাস করেন।
শিক্ষকতা
[সম্পাদনা ]১৯৬৮ সালে লালমাটিয়া গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার শিক্ষকতা জীবনের শুরু। পরবর্তী সময়ে তিনি জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপনা শুরু করেন। কলেজটি জাতীয়করণ হলে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পুরানা পল্টন গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে কলেজের চাকরি ছেড়ে তিনি সাহিত্যসাধনা ও সাংবাদিকতা শুরু করেন।[১]
ভাষা সৈনিক
[সম্পাদনা ]১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নতুন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু এমন যুক্তিতে কোলকাতার আজাদ পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর প্রতিবাদ জানিয়ে এম এম কলেজের ছাত্রী হামিদা রহমান ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি ১০ জুলাই ১৯৪৭-এর সংখ্যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে বাংলা। [২] ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের শিক্ষার্থীরাও গঠন করে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। সেই পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আলমগীর সিদ্দিকী। আর একমাত্র নারী যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন যশোরের অগ্নিকন্যা হামিদা রহমান। আন্দোলন চলাকালীন সময় তার ভূমিকায় শাসক গোষ্ঠী এতটাই খ্যাপা ছিলেন যে, তার পুরাতন কসবার বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালায় পুলিশ। পরবর্তিতে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোর জেলার যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব নিয়ে পুরো দেশে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ দেশব্যাপি হরতাল কর্মসূচি পালিত হয় এবং এ সময় যশোরে ওই কর্মসূচি সফল করার জন্য অন্যদের সঙ্গে হামিদা রহমান অগ্রগামী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। সেদিনের হরতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের কর্মসূচির প্রতি যশোরের মোমিন গালর্স স্কুলের শিক্ষকেরা একমত না হওয়ায় স্কুলের গেট বন্ধ করে ক্লাস চালু রাখা হয়েছিল। এ খবর পাওয়ার পর হামিদা রহমানের নেতৃত্বে মেয়েদের একটি মিছিল মোমিন গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে সমবেত হয়। তিনি ও তার সাথিরা লাথি মেরে স্কুলের গেট খুলে ফেলেন। হামিদা রহমানের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রী মোমিন গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনি দিতে শুরু করেন। ছাত্রী-মিছিলটি মোমিন গার্লস স্কুল থেকে যশোর কালেক্টরেটের সামনে এসে হাজির হলে কোর্টের সামনে দাড়িয়ে হামিদা রহমান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এক পর্যায়ে পুলিশ ওই ছাত্রীসমাবেশে বা লাঠিপেটা করে এবং গুলি চালায়। এতে অনেক আহত হলেও কেউ মারা যাননি। হামিদা রহমান আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন। কিন্তু পুলিশ সুফিয়া নামে একজনকে হামিদা রহমান ভেভে ধরে নিয়ে যায়।
ওইদিন রাতে যশোর কলেজের ছাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের গোপন বৈঠক বসে। হামিদা রহমান ছেলেদের পোশাক পরে সে বৈঠকে যোগ দেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য যশোরে ধর্মঘট চালানো হবে। ধর্মঘট একটানা সতদিন চলে এবং সাধারণ মানুষ তাতে ব্যাপক সাড়া দেয়। উপর্যুক্ত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ধর্মঘট চলার পাশাপাশি ১৩ মার্চ যশোরে হরতাল পালিত হয়। হরতাল কর্মসূচি চলাকালীন সেদিন হামিদা রহমানের নেতৃত্বে যশোরে মেয়েদের একটি মিছিল বের হয়। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ভাষা আন্দোলনে মিছিলে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি হামিদা রহমান। [১]
সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
[সম্পাদনা ]স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন সময়ে প্রগতিশীল ধারার ছাত্র আন্দোলনের সাথে কাজ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের মুক্তির প্রশ্নে দৃঢ় নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা রেখেছেন। সমাজসেবা এবং নারীমুক্তি আন্দোলনে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা স্মরণযোগ্য। যশোরে পুরোনো কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাসহ তিনি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ নারী আন্দোলন সংসদের তিনি সভানেত্রী এবং কার্যকরী সদস্য। তিনি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি সেখানে দুটি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। লন্ডন উইমেন্স অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের মেম্বর ছিলেন। হাউস অব লর্ডস এবং হাউস অব কমেন্স হামিদা রহমান বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ পান।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা
[সম্পাদনা ]রাজনীতি ছাড়াও সাহিত্য ও পত্রিকায় লেখালেখির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। যশোর থেকে প্রকাশিত আল মোমিন পত্রিকার তিনি মহিলা বিভাগের সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করতেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত নববানী মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ষাট ও সত্তরের দশকে ইত্তেফাক পত্রিকার মহিলা বিভাগে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ‘বিলকিস বেগম’ ছদ্মনামে লেখা তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সাহিত্যিক হামিদা রহমান দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক বেগম, দৈনিক আজাদ, সংবাদ, পূর্বাণী, সাপ্তাহিক সেবা, আজকের কাগজ-এর সাথে লেখা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভাগীয় সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ ও বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য। [১]
প্রকাশিত গ্রন্থ
[সম্পাদনা ]স্কুল ম্যাগাজিনে তার লেখার মধ্য দিয়েই হামিদা রহমানের সাহিত্যচর্চার সূচনা। কলেজ ম্যাগাজিনে তার লেখা ‘সর্বহারা’ ও ‘রিকসাওয়ালা’ শীর্ষক ছোটগল্প দুটি প্রকাশিত হলে সুধীসমাজে লেখিকা হিসেবে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
- জীবনস্মৃতি [২] তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে-
- নীল চুড়ি
- বেনারসী
- বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও তার বিকাশ
- অধিকার আন্দোলনে নারী সমাজ[৩]
- নারীর নৈর্বাক্তিক কান্না,
- বিলেতের চিঠি
- নীড় হারা পাখি
- নীলচুড়ি
- স্বাতী
- শাহী মহল
পুরস্কার ও সম্মাননা
[সম্পাদনা ]মৃত্যু
[সম্পাদনা ]হামিদা রহমান দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন পরবর্তীতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে ১৪ আগস্ট ২০০৫ সালে ঢাকায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। [৪]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা ]- ↑ ক খ গ ঘ "যশোরে ভাষা আন্দোলনের সেনানী হামিদা রহমান"। জাগরণীয়া। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০১৯।
- ↑ ক খ "ভাষা সৈনিক হামিদা রহমানের সেই জীবনস্মৃতি এখন এম এম কলেজে"। সমাজের কথা। ২০ ডিসেম্বর ২০১৬। ২৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০১৯।
- ↑ হামিদা রহমানের বইসমূহ। নওরোজ কিতাবিস্তান। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০১৯।
- ↑ "অধ্যাপিকা হামিদা রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ"। আমার যশোর ডট কম। ১৪ আগস্ট ২০১৬। ৬ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০১৯।
আরো পড়ুন
[সম্পাদনা ]- ১৯২৭-এ জন্ম
- যশোর জেলার ব্যক্তি
- বাংলা ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় নারী কর্মী
- বাংলাদেশী সাহিত্যিক
- বাংলাদেশী সাংবাদিক
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- বাঙালি মুসলিম
- ২০০৫-এ মৃত্যু
- সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক
- সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রাজশাহীর প্রাক্তন শিক্ষার্থী